শীতের দেশের টিউলিপ সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে পঞ্চগড়ে

রাজসিক সৌন্দর্য ছড়ানো এই টিউলিপ বাগানের অবস্থান দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার দর্জিপাড়া এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় রাজসিক সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে বিস্তৃত টিউলিপ ফুলের বাগান। মাঘের শীতে বাগানজুড়ে বর্ণিল আভা ছড়ানো এসব ফুল দিচ্ছে বসন্তের আগমনী বার্তা। তেঁতুলিয়ার দর্জিপাড়া এলাকায় টিউলিপের এই বাগানগুলোয় এক সপ্তাহ ধরে ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা।

সম্প্রতি দুপুরে দর্জিপাড়ার টিউলিপ বাগানে গিয়ে দেখা যায়, সূর্যের আলো আর তাপ নিয়ন্ত্রণ করা বিশেষ শেডের (ছাউনি) নিচে সারি সারি ফুটেছে টিউলিপ ফুল। দর্শনার্থীদের কেউ ফুলগুলো ছুঁয়ে দেখছেন, কেউ ছবি তুলছেন, কেউবা মুঠোফোনে ভিডিও কলে দূরে থাকা স্বজনদের দেখাচ্ছেন টিউলিপের সৌন্দর্য। কেউ কেউ আবার ফুল কিনে ফিরছেন বাড়িতে।

দর্শনার্থীরা জনপ্রতি ৫০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে টিউলিপ বাগানে ঢুকছেন। তাঁদের সুবিধার্থে ক্ষুদ্র চাষিরা বাগানের পাশে স্থাপন করেছেন ‘হোটেল টিউলিপ’ নামে একটি রেস্তোরাঁ। যেখানে ফুল দেখতে আসা মানুষ খেতে পারবেন তেঁতুলিয়ার স্থানীয় গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খাবার। সেই সঙ্গে দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের অবস্থানের জন্য করা হয়েছে আবাসনের ব্যবস্থা।

হিমালয়কন্যা খ্যাত শীতপ্রবণ জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার এবার দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষুদ্র চাষিদের মাধ্যমে দুই একর জমিতে খামার পর্যায়ে করা হয়েছে ঠান্ডার দেশের ফুল টিউলিপের চাষ। টিউলিপ উৎপাদনের এই উদ্যোগ নিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও)। এই প্রকল্পটিতে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। চাষিদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা, তাঁদের পরিবারে আয় বাড়ানো, বিদেশ থেকে টিউলিপ ফুল আমদানি কমানো, পঞ্চগড় জেলাকে পর্যটন উপযোগী জেলা হিসেবে গড়ে তোলাসহ ভবিষ্যতে বাণিজ্যিকভাবে উন্নত জাতের টিউলিপ ফুল উৎপাদনে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চাষিদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করাই এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ইএসডিও। বছরের প্রায় চার মাস পঞ্চগড়ে শীতার্ত আবহাওয়া থাকায় এখানে বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

চোখজুড়ানো টিউলিপ বাগান দেখতে এসে স্ত্রী-সন্তানের ছবি তুলছেন এক ব্যক্তি। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার দর্জিপাড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীতপ্রধান দেশে টিউলিপ ফুলটি হরহামেশাই দেখা যায়। কিন্তু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে এটি তেমন একটা দেখা যায় না। টিউলিপ ফুল চাষের ক্ষেত্রে দিনের বেলা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং রাতে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহনশীল ধরা হয়। এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রা হলে প্রাপ্তবয়সের আগে মানসম্মত ফুল নাও ফুটতে পারে। স্বাভাবিকভাবে রোপণের ১৮ থেকে ২০ দিনের মধ্যে কলি আসতে শুরু করে এবং ২৫ থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত টিউলিপ ফুল স্থায়ী হয়। অনেক সময় আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে এর ব্যতিক্রমও হতে পারে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শীতপ্রধান এলাকা হিসেবে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলাকে নির্বাচন করেছে ইএসডিও। গত ১০ জানুয়ারি উপজেলার দর্জিপাড়া গ্রামের ২০ জন নারী উদ্যোক্তা চাষির মাধ্যমে সম্প্রতি নেদারল্যান্ডস থেকে আনা টিউলিপ গাছের বাল্ব (বীজ হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত কাণ্ড) রোপণ করা হয়। ২০ জন চাষি মোট ২ একর জমিতে ১০ প্রজাতির ১ লাখ টিউলিপের বাল্ব রোপণ করেন। এই ফুল ফোটাতে ব্যবহার করা হয়েছে উচ্চ কৃষিপ্রযুক্তি। ফুলগুলো একটি বিশেষ শেড নেটের (ছাউনির) নিচে চাষ হচ্ছে। আর চারপাশ ঘিরে দেওয়া হয়েছে বিশেষ নেট দিয়ে, যা তাপ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ করে সূর্যের আলো।

তেঁতুলিয়ার টিউলিপ প্রকল্পে এবার রোপণের ২২ দিনের মাথায় ফুটতে শুরু করেছে মনোমুগ্ধকর টিউলিপ। ১০ প্রজাতির ১০টি রঙের মধ্যে প্রায় প্রতিটি ফুলই ফুটেছে সারি সারিভাবে। অ্যান্টার্কটিকা হোয়াইট (সাদা), ডেনমার্ক (কমলা ছায়া), লালিবেলা (লাল), ডাচ সানরাইজ (হলুদ), মিষ্টিকভ্যান ইজক (গোলাপি) সহ ফুটেছে নানা রঙের টিউলিপ। বিস্তৃত পরিসরে টিউলিপের বৈচিত্র্যময় উপস্থিতি বাগানজুড়ে ছড়াচ্ছে শুভ্রতা।
পরিবারের সঙ্গে টিউলিপ ফুল দেখতে আসা দিনাজপুরের তরুণী সাবা নুর বলেন, ‘এর আগে ফেসবুক, টেলিভিশন আর ইউটিউবেই শুধু টিউলিপ দেখেছি। কিন্তু বাস্তবে এভাবে কখনো টিউলিপ ছুঁয়ে দেখা হয়নি। সত্যি দেশের মাটিতে এমন বিদেশি ফুল দেখে আমি অভিভূত।’

টিউলিপ চাষি ও উদ্যোক্তা সুমি আক্তার বলেন, ‘বর্তমানে বাগান থেকেই একেকটি ফুলের স্টিক ১০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া একেকটি টবসহ ফুল ১৫০ টাকা দরে বিক্রি করছি। অল্প সময়ের মধ্যে হওয়া এই ফুল চাষ করে আমরা লাভবান হব বলে আশা করছি। আর এবার লাভবান হলে ভবিষ্যতে আমরা আরও বড় পরিসরে টিউলিপ চাষ করতে চাই।’

ইএসডিওর এই প্রকল্পের উপসমন্বয়ক মো. আইনুল হক বলেন, নেদারল্যান্ডস থেকে টিউলিপের একেকটি বাল্ব আনতে এবার ৫৫ টাকা খরচ হয়েছে। গত বছরের পাইলট প্রকল্প সফল হওয়ায় এবার দ্বিতীয়বারের মতো বাণিজ্যিকভাবে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র চাষিদের মাধ্যমে উৎপাদিত এসব ফুল বিক্রির জন্য ইতিমধ্যে ঢাকার ফুল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।

এর আগে ২০২২ সালে তেঁতুলিয়া প্রথমবারের মতো পাইলট প্রকল্প হিসেবে উপজেলার শারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়া গ্রামের আটজন নারী উদ্যোক্তা চাষির মাধ্যমে ৪০ শতক জমিতে ৬ প্রজাতির ৪০ হাজার টিউলিপ ফুল চাষ করেছিল ইএসডিও। ওই প্রকল্পে গত বছরের ১ জানুয়ারি টিউলিপ বাল্ব রোপণের ২৩ দিনের মাথায় ফুল ফুটতে শুরু করেছিল। ওই সময় নেদারল্যান্ডস থেকে টিউলিপের একেকটি বাল্ব আনতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৬২ টাকা।